ঘুরে বেড়ানো শখের জন্মটা যে কবে হলো, ঠাহর করতে পারি নি। একদিন হঠাৎই আবিষ্কার করলাম যে, ঘুরতে ভালোলাগে, বেড়াতে ভালোলাগে। ততোদিনে ঢাকার আশেপাশের অনেক জায়গা ঘুরাঘুরি শেষ। ঘুরাঘুরি বলতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হঠাৎ একটা জায়গায় চলে যাওয়া, যেখানে হয়তো ঠিক ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে কেউ আগে যায় নি; অথবা আমার বা আমাদের মতো বায়ুচড়া বড়জোড় দুয়েকজন গেলেও যেতে পারে। একদিন যেমন আমরা ধামরাই বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশাওয়ালাকে বললাম, এই রাস্তায় ১০ টাকা দিয়ে যতোদূর যাওয়া যায় ততোদূর যাব। সেখান থেকে বাকি ঘণ্টা কয়েক হাঁটাহাটি করে সময় পার। দুপুরে খেলাম একটা রেস্টুরেন্টে- যদি তাকে আদৌ কেউ রেস্টুরেন্ট বলে। আবার একদিন মাওয়া যাওয়ার রাস্তায় হুট করে কোথায় যেন নেমে গেলাম- হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখি সামনে পদ্মা। তীরে ভাতের দোকান। দুই পিস ইলিশ, এক পিস রুই মাছ ভাজা, এক পিস খাসির মাংস, সবজি, ছোট মাছ আর ভর্তা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে শুনি বিল হয়েছে প্রতিজনের একশ বিশ-ত্রিশ টাকা করে। ঘটনাটা অবশ্য ২০০৬ সালের, কিন্তু স্বয়ং নাগাল্যান্ডের সন্ন্যাসীও এতোগুলো জিনিসের দাম কম করে হলেও দুশ টাকা করে ধরতেন! অভিজ্ঞতা বিক্রি করে ধনী হওয়া গেলে মার্ক জুকারবার্গের আগেই তরুণ বিলিওনিয়ার হওয়াটা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না!
২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে ব্র্যাকে জয়েন করার পর নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করে বিমোহিত হয়ে গেলাম- প্রতি দু-তিন মাসে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর আগে গোটা দশেক জেলায় হয়তো গিয়েছি, কিন্তু এই কাজে পুরো দেশ দেখার সুযোগ মিলবে। আস্তে আস্তে পরের কয়েকটি বছর চোখের সামনে দিয়ে দেখেছি আমি- কীভাবে একের পর এক উপজেলায় যাচ্ছি, ঘুরছি, ফিরছি, মানুষের সাথে মিশছি, রেস্টুরেন্টে নানা রংবেরঙের তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছি, চিনিসহ ও চিনিছাড়া চায়ের স্বাদ নিয়ে কিংবা টাকি বিস্কুট কামড়ে দাঁতে ব্যাথা করতে করতে ডেরায় ফিরছি- মানুষ ও ভাষাবৈচিত্র্যের কথা না হয় না-ই বললাম!
ততোদিনে পার হয়েছে পাঁচ-পাঁচটি বছর। ব্র্যাকে থাকতে কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের নামকরা বা দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যাই নি। বেঁচে থাকলে কক্সবাজার, জাফলং, বিরিশিরি ইত্যাদি জায়গায় যাওয়া হবে; কিন্তু অভয়নগর, সোনাতলা, বরকল কিংবা বিশ্বনাথে কোনো নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া যাওয়া যাবে না। অধিকাংশ সময়েই সাথে গাড়ি থাকায় ইচ্ছে হলেই নেমে গেছি রাস্তায়, কিংবা কোনো গ্রামে। থাকার কথা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িতে; কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় থেকে গেছি নাগেশ্বরীতে। একেকটি উপজেলার একেকটি রাত আমার একেকটি আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা!
গতকাল রাতে বসেছিলাম কোন কোন এলাকায় গিয়েছি তার একটা তালিকা করার। ঘণ্টাদুয়েক কাজ করার পর যে ছবিটি দাড়ালো, তা এরকম। আমার ধারণা ছিলো, ‘বুঝি বা ঘুরিয়াছি আরেকটু বিশাল দেশ’। ম্যাপটি দেখার পর কিছুটা হতাশই হলাম- গ্রামীণের পরেই আমার নেটওয়ার্ক হলেও কভারেজটা আরেকটু বেশি বলেই ভেবেছিলাম।
কিছুদিন আগে অন্য একটি এনজিওতে যোগ দিয়েছি। ওখানেও ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে; কিন্তু তা সীমিত এলাকায়। এখন হয়তো বারবার যাওয়া হবে খানসামা, চিরিরবন্দর, হাতীবান্ধা, জলঢাকা, বরগুনা কিংবা শ্রীপুরে। কিন্তু পুরো বাংলাদেশ দেখার যে সুযোগটি আমার ছিল গত কিছুদিন আগেও, সেটা এক ধাক্কাতেই কমে গেছে অনেকটা।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছেটা প্রবলতর হয়ে উঠছে সময় সময়। আগামীতে কী করবো জানি না। হয়তো উদ্দেশ্যহীনভাবে শুক্র-শনিবারগুলোতে বেড়িয়ে পড়বো! কে জানে কী হয়! আচ্ছা, যদি সিদ্ধান্ত নিই,বয়স পঞ্চাশ আসার আগেই বাংলাদেশের সবকটি উপজেলা ঘুরে আসবো, তাহলে সেটি কি বেশি উচ্চাভিলাষী হয়ে যাবে?
Leave a Reply