আগামী জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালেয় কারিগরি শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতি উপজেলার অন্তত একটি বিদ্যালয়ে এ শিক্ষা চালু করা হবে এবং ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী শিক্ষার্থীদের এর আওতায় আনা হবে।
বর্তমান সরকারের শিক্ষাবিষয়ক বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ আছে। সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি হচ্ছে একটি নতুন শিক্ষানীতি উপহার দেয়া যা সংসদের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত হবে বলে আশা করা যায়। এ শিক্ষানীতিটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রাথমিক শিক্ষা মেয়াদ বাড়ানো এবং কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কিন্তু ক্রমবিকাশমান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষা সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে; কিন্তু বাংলাদেশে সেই অর্থে এ নিয়ে কোনো কাজ হয় নি। বরং কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারার বাইরেই রাখা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থীদের কখনোই কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হতে উৎসাহিত করা হয় নি, অভিভাবকেরাও চান নি তাদের সন্তান মূলধারার শিক্ষায় না গিয়ে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হোক। নীতিনির্ধারকেরাও এই শিক্ষাকে এমন কোনো গুরুত্ব দেন নি যাতে মানুষের এ ধারণা হবে যে কারিগরি শিক্ষা ক্লাসের দ্বিতীয় স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ কারিগরি শিক্ষার ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মতোই গুরুত্ব দিতে চায়।
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, নতুন শিক্ষানীতি আগামী বছরের শুরু বা এ বছরের শেষ থেকে বাস্তবায়িত হবে। সে হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বছরের শেষে বিপুল পরিমাণ কাজের বোঝা নিয়ে নামতে হবে- আনঅফিসিয়ালি বোধহয় এখনই নামতে হয়েছে। একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই ধরনের বিপুল পরিবর্তন সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বাড়ানো সরকারের জন্য বেশ কষ্টকরই হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা যেমন বাড়াতে হচ্ছে, তেমনি তৈরি করতে হচ্ছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক। তাছাড়া বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে থাকা বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী হবে তাও ভাবতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কারিগরি শিক্ষাকেও আলাদা করে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে সরকারকে যেখানে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি অনুসারে কারিগরি শিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনার দিক মোটামুটি ঢেলেই সাজাতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় হুট করে আগামী জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো তা পরিষ্কার নয়। এটি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আলাদা কোনো উদ্যোগ কিনা তাও পরিষ্কার নয়। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, এ কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দশ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। সে টাকা একসঙ্গে না পাওয়া গেলে পুরো পরিকল্পনা ধাপে ধাপে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। খবরের এ অংশ থেকে মনে হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা চালুর এ উদ্যোগটি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির উদ্যোগ থেকে আলাদা। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে প্রস্তাব অনুসারে কারিগরি শিক্ষার জন্য অবশ্যই আলাদা বাজেট থাকার কথা এবং নতুনভাবে বিন্যস্ত প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষাপর্যন্ত কোথায় কীভাবে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হবে, তারও একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলে শুনেছি। সামনে যখন এরকম একটি পরিকল্পনা আছে, তখন কেন শুধু তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এর আওতায় আনা?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে দেশব্যাপী ৭৩টি বিদ্যালয়ে বর্তমানে এ শিক্ষা চালু আছে। মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জীবনমুখী শিক্ষাকে সমন্বিত করার প্রয়াসে প্রাথমিক পর্যায়ে এ কারিগরি শিক্ষার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু এর জন্য এখনই সময়টা বেছে নেওয়া হলো কেন? এটা কি কেবল উদ্যোগের পর উদ্যোগ নিয়ে জানান দেয়া যে আমরা প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কাজ করে যাচ্ছি? নাকি এটাও নির্বাহী আদেশে চলা শিক্ষাব্যবস্থার যুক্ত হওয়া আরেকটি নতুন আদেশ-মাত্র; কিছুদিন পরই যার কোনো প্রত্যক্ষ ফলাফল পাওয়া যাবে না, কিন্তু ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে যাবে বেশ কিছু অর্থ?
এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে, আমাদের সার্বিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি করে সত্য। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতেও কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা আসলে কতোটুকু দরকার, কোন পর্যন্ত এর পরিসীমা হবে কিংবা এ খাতে আমাদের দক্ষ জনশক্তি আসলে কতোটুকু দরকার, তার হিসেব-নিকেশ কি আছে কারো কাছে? যতদূর জানি, নেই। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর কোনো গবেষণা নেই। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার আবার বেশ কিছু ভাগ রয়েছে। আগামী বিশ বছরে এই প্রত্যেকটি ভাগে কী পরিমাণ জনশক্তি রয়েছে, কী পরিমাণ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করা যাবে, কোন স্তর পর্যন্ত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা যথেষ্ট- এ ব্যাপারে গবেষণার অপ্রতুলতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এ নিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবও। এ অবস্থায় হুট করে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু করাটা কোন অর্থে প্রয়োজন হলো, সেটি স্পষ্ট নয়। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিকে এই কর্মকাণ্ড সাপোর্ট করবে, তাতেও সন্দেহ থেকে যায়। কারণ প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে আট বছর এবং সেখানে কারিগরি শিক্ষা চালু হলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে চালু করার কথা। এ অবস্থায় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী সময়সীমায় এই শিক্ষা চালু করে সরকার আসলে এ থেকে কী অর্জন করতে চায়?
বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, বিগত শিক্ষামন্ত্রীদের তুলনায় বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে বেশ খোঁজখবর রাখেন এবং বিষয়টি তিনি বুঝেনও। সম্ভবত তাঁর পূর্বোক্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, নিজস্ব আগ্রহ এবং শিক্ষা বিষয়ে তাঁর দলের অব্স্থানই তাঁকে নানা সময়ে শিক্ষা-সম্পর্কিত নানা উদ্যোগ নিতে আগ্রহী করেছে। শিক্ষা নিয়ে তাঁর নানা বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড দেশের শিক্ষার একটি আমূল সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা সার্বিক পরিকল্পনার মধ্যেই সব আয়োজন থাকা দরকার। যে সময়ে একটি বড় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে কথা উঠছে, সে সময় ছোটখাট এসব উদ্যোগ না নেয়াই ভালো। দূরবর্তী লক্ষ্যকে সামনে না রেখে এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করলে তাতে সময় যেমন নষ্ট হবে, তেমনি অর্থও খরচ হবে যেগুলো দিয়ে বড় পরিকল্পনাকে অনেকটা সাপোর্ট দেয়া যায়। আর তাছাড়া, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ যদি নিতেই হয়, তাহলে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে সেটার অধীনে করা দরকার। এই মুহূর্তে সবার আগে দরকার নতুন শিক্ষানীতিটাকে শক্ত করে বাস্তবায়ন করা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার উচিত সেদিকেই নজর দেওয়া। অনেক ভালো ভালো পরিকল্পনা কিংবা বাজেট আসবে- কিন্তু একটু ভেবেচিন্তে আস্তেধীরে করলেই বরং এর থেকে পূর্ণ সুফলটুকু পাওয়া সম্ভব।
Leave a Reply