গত দু’দশকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় যে পরিমাণ উদ্যোগ, মনোযোগ বা সহায়তা দেখা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা তার ছিটেফোঁটা পায় নি। মূলত ১৯৯০-এর পর থেকে সবার জন্য শিক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে বাংলাদেশের কমিটমেন্টের কারণে এবং প্রাথমিক স্তরে রুগ্ন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবেই এ সেক্টরে বিশেষ নজর দিতে হয়েছিল। দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে, বিশেষত দরিদ্র পরিবারের ঝরে পড়া ছেলেমেয়েদের পুনরায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে এনজিওরাও এসময় এগিয়ে আসে। বিদেশ থেকেও এ সময়কালে প্রচুর সহায়তা এসেছে। সেগুলোর সিংহভাগই প্রাথমিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এবং তাদের সহায়তায় দেশের দুটো বড় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। শুরু হচ্ছে তৃতীয়টির কাজ। বলা যায়, সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নে যতোটুকু মনোযোগ পাওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা সেক্টর ততোটুকু বা বেশি মনোযোগ পেয়েছে। যদিও এতে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায় নি; কিন্তু এতেও বাংলাদেশ যে অর্জন দেখিয়েছে, সেটি এখন বিশ্ব পরিমণ্ডলে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যে পরিমাণ উদ্যোগ এই সেক্টরে দেখা গেছে, তাতে যথাযথ পরিকল্পনা থাকলে বাংলাদেশের অর্জন আরো অনেক বেশি হতো তাতে সন্দেহ নেই।
তুলনায় মাধ্যমিক শিক্ষা কম নজর পেয়েছে। আমাদের এমন পরিমাণ সম্পদ নেই যা দিয়ে একইসাথে একাধিক শিক্ষাস্তরের প্রতি পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ দিতে পারবো। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি ওই মনোযোগটা ছিল সময়ের চাওয়া। শিক্ষার এ স্তরটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছতে না পারলে মাধ্যমিকসহ অন্য স্তরগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবেই একে শক্তিশালী করার যতো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তার প্রায় সবই নেওয়া হয়েছে। এ সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা চলেছে রুটিন অনুসারে। এনজিও ও বিদেশি সহায়তাগুলো প্রাথমিকে অনেক মনোযোগ দিলেও কোনো কারণে তারা মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতি নজর দেয় নি। সরকারিভাবে বাধানিষেধ বা অনাগ্রহ ছিল কিনা কে জানে! তবে সাধারণভাবে মনে হয়, সবাই আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচি বাস্তবায়নেই আগ্রহ দেখিয়েছে, অন্য কোনোখানে নয়।
গত বিশ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা একটি দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছেছে। অনেক উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ অবস্থান হয়তো পেছনে, কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। যেটুকু ঘাটতি আছে, সেটুকুও এ সময়ে পূরণ করার যাবে বা হয়তো সবসময়ই কিছু না কিছু ঘাটতি থেকেই যায়। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার এখন সর্বোচ্চ। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক হলেও আস্তে আস্তে কমছে। গুণগত মান আশাব্যঞ্জক না হলেও বেশ কিছু চেষ্টা-উদ্যোগ চলছে। প্রাথমিক শিক্ষার অর্জনের প্রভাব আস্তে আস্তে মাধ্যমিক শিক্ষাসহ অন্য স্তরগুলোতেও পড়ছে। তবে প্রাথমিকের লাগোয়া বলে মাধ্যমিকে এর প্রভাবটা বেশি এবং তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
বছর দশেক আগেও যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মাধ্যমিকে ভর্তি হতো, সেই সংখ্যা এখন বহুগুণে বেড়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয় সে অনুপাতে বাড়ে নি। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীর তুলনায় বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অপ্রতুল হলেও মাধ্যমিকে এ সংকটটি নানাভাবে শিক্ষাকার্যক্রমকে ব্যহত করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। তাছাড়া মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, বিশেষত মেয়েদের বিশাল অংশ ঝরে পড়ে এসএসসির আগেই।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় যে নানা সংকট রয়েছে, সেগুলো দিন দিন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বছর দেড়েক আগে গণসাক্ষরতা অভিযান থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা যেমন জানা গেছে, তেমনি এর সংকটের ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কেও জানা গেছে। তবে মাধ্যমিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় সংকট বোধহয় এখন, যে সংকটকে এক অর্থে আত্মপরিচয়ের সংকটও বলা যায়।
কিছুদিন আগে যে নতুন শিক্ষানীতিটি সংসদে পাশ হলো, সেটি অনুসারে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা হবে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। শিক্ষাস্তরের এই নতুন বিন্যাস বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক না হলেও সম্পূরক নয়। বরং বর্তমান ও প্রস্তাবিত- দুই শিক্ষাব্যবস্থার চরিত্র ভিন্ন। ভিন্ন হওয়ার কারণ শুধু শিক্ষানীতি নয়, দেশের বিদ্যমান আইন ও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিষয়গুলোও এর সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত।
প্রথমেই আসি আইনের দিক দিয়ে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক বাবা-মা তাদের প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য। না পাঠালে আইন অনুসারে শাস্তির বিধানও রয়েছে। সরকারও বাধ্য ৬-১১ বছর বয়সী সব শিশুর শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দিতে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হওয়ায় তা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে। আইনানুযায়ী পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষার কথা বাধ্যতামূলক বলা হলেও এখন প্রাথমিক শিক্ষা হবে আট বছরের। সাথে এক বছরের প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা ধরলে আরো এক বছর বাড়ে। কিন্তু শিক্ষানীতি পাশ হলেও এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হয় নি। এ সময়ের মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন সংশোধন করা হবে কিনা তাও জানা নেই। সুতরাং এখন যদি কোনো অভিভাবক সন্তানকে পঞ্চম শ্রেণীর পর আর না পড়ান, তাহলে আইনি দিক দিয়ে কিছু করার নেই। বাস্তবায়ন পুরোপুরি শুরুর আগ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এখন আসলে কয় বছরের সেই দ্বিধাটি থেকেই যাচ্ছে।
খুব ভালো হতো যদি শিক্ষামন্ত্রী বা সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে কিছু বলতেন। কারণ শুধু আইন তো নয়, এই শিক্ষানীতির কারণে দেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু কাঠামোতে বড় আকারের পরিবর্তন আনতে হবে। সেটা খুব সহজ কাজ হবে না। কারণ এ পরিবর্তন শুধু বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণও। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষাক্রমের সাথে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষাক্রমের মিল নেই, ধারাবাহিকতা নেই। পঞ্চম শ্রেণী পাশের পর শিক্ষার্থীকে লাফ দিয়ে বড় সিলেবাসে হাবুডুবু খেতে হয়। নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার সময় এ ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে এবং সব মিলিয়ে কাজের পরিমাণ নেহায়েত কম নয়।
বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে আসলে বলতে হয়, শিক্ষার এ নতুন স্তর কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা পরিষ্কার নয়। সরকারিভাবেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলা হয় নি। শোনা গিয়েছিল, শিক্ষানীতি তৈরির সময় সরকারকে কীভাবে এই বিপুল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে হবে, সে সম্পর্কে একাধিক সুপারিশ করা হয়েছিল। সরকার অবশ্যই নতু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কোনো না কোনো পথ ধরে এগুচ্ছে, কিন্তু পদ্ধতিটা কী তা যারা এই প্রক্রিয়ার বাইরে, তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। যে কারণে অনেকে মনে করেন, সরকার উচ্চাভিলাষী একটা শিক্ষানীতি তৈরি করেছে কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা সন্দেহ।
পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প বা পিইডিপি ২ শেষ হয়ে নতুনভাবে তা আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রোগ ৩ নামে শুরু হচ্ছে এই সময়েই। প্রাথমিক শিক্ষার এই সবচেয়ে বড় কর্মসূচিটি দিয়ে অনেক কিছুই বদলে দেয়া সম্ভব যা আগের দুটো পর্যায় থেকে পরিষ্কার। কিন্তু এই প্রোগ ৩-এ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ কি আট বছর ধরা হয়েছে নাকি পাঁচ বছর তা নিশ্চিত নই। তবে শুনেছি প্রোগ ৩-এ নাকি প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে পাঁচ বছর ধরেই যাবতীয় পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটা হলে পুরো কাজটিই হবে শিক্ষানীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
সরকার শিক্ষানীতি পাশ করেছে, বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্বও সরকারের। নিশ্চয়ই এসব বিষয় নিয়ে নানা দিক বিবেচনা করে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকারের পদক্ষেপগুলো আমাদের জানা নেই, বা কিছু জানানোও হচ্ছে না। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে- প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি একইসাথে মাধ্যমিক শিক্ষাকেও যাতে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়। না হলে পাঁচ-দশ বছর পর দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা কোমরভাঙ্গা অবস্থান থেকে দাড়াতে পারবে না।
Leave a Reply