ব্লগে লেখালেখির একটা বড় সুবিধা হচ্ছে যে, মানুষজন ব্লগের লেখা এবং লেখকের ব্যাপারে কী ভাবছে- তা সহজেই জানা যায়। এখানে ভুংভাং করে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পত্রিকায় একটি কলাম লিখলে সেই পত্রিকার তালিকাভুক্ত কোনো কলামিস্ট যদি ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয় বা প্রশংসা করেন, তাহলে হয়তো কলাম লেখকের একটি নির্দিষ্ট লেখার পক্ষে বা বিপক্ষে দুএকটা ছত্র থাকতে পারে। না হলে কলামিস্ট যা লিখবেন, তা-ই সই। আজকাল অবশ্য পত্রিকাগুলোর ইন্টারনেট সংস্করণে মন্তব্য করা যায়- কিন্তু তাও মডারেটেড। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের পছন্দ না হলে অনেক মন্তব্য প্রকাশ হয় না। আমি নিজে একটি বড় পত্রিকার কয়েকটি খবর ও কলামে একসময় কিছু মন্তব্য করেছিলাম- কিন্তু অধিকাংশই প্রকাশ হয় নি। কলামিস্টের ভুল ধরিয়ে দেয়া মহাপাপ! পত্রিকার আদর্শের বাইরে মন্তব্য করা গর্হিত কাজ!
রাজশাহী শহরটা শান্ত (আরাফাত শান্ত না) হলেও দিনগুলো আমার মোটেও শান্ত কাটছে না- এক ধরনের ব্যস্ততা বেড়েছে। নেটে লগইন থাকি প্রায়শই, কিন্তু আসলে নেটে থাকি না। এ নিয়ে বিড়ম্বনাও হয়। অফিসে ঢুকে নেট লাইনে সংযোগ দিয়ে আপডেট দিয়ে রাখি- অ্যান্টিভাইরাস বা কোনো সফটওয়্যারের। এই ফাঁকে ক্লাস নিতে থাকি, অন্য কাজ করতে থাকি। ব্যস্ততার সময়টুকুতে এই বাড়তি কাজগুলো শেষ হয়ে যায়। স্কাইপে লগইন থাকি বলে ফেসবুকেও লগইন দেখায়। মানুষজন মনে করে সারাদিন নেটেই থাকি। আজকে এক বন্ধু বললো- বইমেলা নিয়ে এবিতে সিরিজ দিচ্ছি কিন্তু মানুষজনের মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছি না কেন? তাঁকে কী করে বুঝাই- মন্তব্য দেয়াটাও লেখার মতো কষ্টকর কাজ। মন্তব্য পড়তে হয়, গুছিয়ে লিখতে হয়। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে সেই অনুযায়ী উত্তর দিতে হয়। লেখায় ভিন্নমত পোষণ করলে নিজের যুক্তিগুলো আবার গুছিয়ে উত্তর দিতে হয়। ফলে লেখার কষ্ট আর মন্তব্যের কষ্ট- দুটোই কাছাকাছি হয়ে যায়। খুব কষ্ট করে লেখার জন্য সময় বের করছি- মন্তব্যের জন্যও সময় বের করা দরকার- এটাও বুঝতে পারি। এতো এতো সুন্দর লেখা আসছে- সেগুলোতেও মন্তব্য করা হচ্ছে না। তবে দেরিতে হলেও সবার মন্তব্যের জবাবই দেয়ার চেষ্টা করি (বলেন তো, কলামিস্ট হলে কি এই কাজটা করতে হতো?)। এই যেমন আগের লেখাটিতে বই প্রকাশ এবং বিক্রির ব্যাপারে দুয়েকটা কথা বলেছিলাম, লীনাপা তাঁর ভাইয়ের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে একটা বিশদ মন্তব্য করেছেন। এরকম মন্তব্যে লেখা সার্থক মনে হয়। ব্লগজগতে আমার বিচরণ অনেকদিনই হয়ে গেল। একটা বিষয় বুঝেছি যে, খালি ব্লগ লিখলেই হয় না, ব্লগের মন্তব্যের উত্তর দিতে হয় যথেষ্ট ধৈর্য্যসহকারে এবং মন্তব্যকারীর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। প্রয়োজনে লেখার চেয়ে মন্তব্যের পরিসর বড় হতে পারে, মূল লেখার বাইরে মন্তব্যের কথাগুলোও আকর্ষণীয় হতে পারে। এমনকি অনেক মন্তব্য দেখেছি যেটা মূল লেখার চেয়ে অনেক বেশি গুণগতমানসম্পন্ন। অনেক মন্তব্য শব্দসংখ্যার দিক দিয়ে মূল লেখাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। যে সমস্ত ব্লগাররা তাদের লেখায় মন্তব্যের এই দিকটাতে খেয়াল দেন, তাদেরকে পছন্দ করি। কারণ তাঁরা কিছু একটা লিখেই পালিয়ে যেতে চান না বা পারেন না, পাঠককে মোকাবিলার সাহস থাকা উচিত।
মন্তব্য নিয়ে এতো কথা বলার কারণ হলো- জনপ্রিয় কয়েকটা ব্লগের বইমেলা সংক্রান্ত পোস্ট দেখে মনে হলো- কার কী বই এসেছে সেটা যতোটা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে মন্তব্যের সংখ্যা ও মান একেবারেই দুর্বল। বই নিয়ে আলোচনার জায়গাটা সেখানে ক্ষীণ, বরং ‘বইমেলায় গিয়েই আপনার বইটা কিনে ফেলব’ কিংবা ‘দারুণ কাজ করেছেন’ বা ‘প্রচ্ছদ সুন্দর হয়েছে’ বা ‘আপনার কাছ থেকে প্রতিবছরই এরকম একটা করে বই চাই’ ধরনের মন্তব্য। এগুলো যে খারাপ তা না, কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি বই-সম্পর্কিত আলোচনা থাকাটা জরুরি। আবার অনেক বই-সংক্রান্ত ব্লগে লেখক (এবং ব্লগার) শুধু বইয়ের নাম, লেখকের নাম, প্রচ্ছদ, দাম আর কোন স্টলে পাওয়া যাবে- এটুকু দিয়েই খালাস। কিন্তু ব্যক্তিগত গণ্ডীর বাইরে পাঠককে আকৃষ্ট করতে চাইলে বইতে কী আছে সেটার একটা বর্ণনা দরকার। অন্তত ফ্ল্যাপে যা থাকে সেটুকু তুলে দেয়া জরুরি। কেউ যদি গল্প-সংকলন বের করেন, তাহলে সেখানে কী ধরনের গল্প আছে, এই গল্পগুলো পাঠকের পড়া কেন জরুরি তার যদি একটা বয়ান দেন, তাহলে পাঠক যেমন বইটির ব্যাপারে বিশদ জানতে পারেন; তেমনি লেখকের প্রচারকাজটা আরেকটু জোরালো হয়।
অপরদিকে যারা এসব ব্লগে বা ফেসবুক শেয়ারে ‘মেলায় গিয়েই বইটা কিনে ফেলবো’-ধরনের কথা বলেন- আমার কেন যেন মনে হয়- অন্তত তিনি এই বইটা আদপেই কিনবেন না। বছর দুই আগে একটি বই প্রকাশ উপলক্ষ্যে একটি বিজ্ঞাপন-জাতীয় লেখা প্রকাশিত হলো প্রচণ্ড জনপ্রিয় একটি ব্লগে। ফেসবুকেও লেখক ইভেন্ট-টিভেন্ট বের করে ম্যাসাকার অবস্থা! মন্তব্যে দেখি সবাই বইটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি বিদেশ থেকেও কয়েকজন পাঁচ কপি, দশ কপি করে কিনবেন বলে মন্তব্য করছেন। অবস্থা দেখে কিছুটা বিস্মিত- এই ধরনের বইয়ের চাহিদা এমন প্রবল! বইটি তখনো বের হয় নি! সৌভাগ্যক্রমে প্রকাশককে চিনতাম বলে বললাম- আপনার এই বই মনে হচ্ছে দারুণ চলবে! তিনি একটু চিন্তাযুক্ত স্বরে বললেন- আপনি সম্ভবত ব্লগ আর ফেসবুক দেখে এই আইডিয়া করছেন? আমিও ভাবছি হয়তো প্রথম সংস্করণের সবগুলো বই বিক্রি হয়ে যাবে। তার পরপরই তিনি সংশয় প্রকাশ করে বললেন- শেষ পর্যন্ত কয়টা বিক্রি হয় তা অবশ্য বুঝতে পারছি না। বইমেলা শেষ হওয়ার পরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, মানুষজের মন্তব্যের ভিত্তিতে তিনি ৫০০ কপি ছাপিয়েছিলেন, বিক্রি হয়েছে ৩২ কপি!
ব্লগ কিংবা ফেসবুকের এই অসুবিধাটুকু লেখক-প্রকাশক সবারই জানা থাকা জরুরি। তার চেয়ে জরুরি হলো, মন্তব্যকারীদের এ ধরনের মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সংযত হওয়া উচিত। ব্লগে প্রচুর মানুষের সাথে পরিচয় হয়। তাদের অনেকের বই বের হয়। পরিচিত বা বন্ধুত্ব থাকলেই যে সবার বই কিনতে হবে, তার কোনো মানে নেই। ব্লগে এবং ফেসবুকে আমার যতো বন্ধু বা পরিচিতজনরা বই প্রকাশ করছেন, তাদের সবার বই কিনতে গেলে আমার পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিতে হয়। আমি সেটা পারবো না। অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীরের লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি প্রথমবার আমার কেনা হয় নি। এই বইটার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল প্রচুর, কিন্তু মনে হয়েছে, যে অবিশ্বাসকে তাঁরা ধারণ করেন, আমিও সেটা ধারণ করি। ব্যক্তিগত কমনসেন্সের বাইরেও তাঁরা এগুলোর খুঁটিনাটি জানেন বলে আরও প্রচণ্ডভাবে ধারণ করেন, সেগুলোর প্রচার করেন; আমি আমার কমনসেন্সটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। কিন্তু আরও কিছু জানা থাকলে অসুবিধা নেই ভেবে বইটি কিনতে গিয়ে দাম দেখে চলে এসেছি। পরেরবছর মানে গতবছর যখন বইটির সুলভ সংস্করণ প্রকাশ হলো, সেবারের মেলায় যেদিন বইটি মেলায় প্রথম দেখি, সেদিনই কিনে ফেলেছি। এবারও হাইকু, বাইকু ও সেনরু নিয়ে মুজিব মেহদীর বইটি উল্টেপাল্টে দেখেছি, কিন্তু দাম কম থাকলেও কেনা হবে না। কারণ যতোই আগ্রহ থাকুক, অন্য অনেক বিষয়ের প্রতি আমার আরও বেশি আগ্রহ। শিক্ষা বিষয়ে কয়েকটা গবেষণার বই কেনাটা জরুরি। একইভাবে কেনা হবে না তানবীরা আপা কিংবা রণদার বই। যদি কোনোদিন সুযোগ আসে, কারও কাছ থেকে ধার করে নিয়ে পড়বো। সুতরাং স্বল্প এবং টানাটানির বাজেটে বাছবিছার করতে পারাটা বড় দক্ষতা। নিজের পছন্দের এবং বিশেষত প্রয়োজনের জন্য এই বাছবিচারটা আমাকে করতেই হয়।
এখন আমি এই তিন লেখকের, যাদের নাম বললাম উপরে, বই যদি না কিনি, তাহলে তাঁদের সাথে আমার সম্পর্কের ঘাটতি হবে না। বরং না কিনে কিনবো কিনবো বলে রব তুললে লেখকদেরই ক্ষতি। এসব ব্লগ বা ফেসবুকের মন্তব্য লেখকরা দেখেন, তাঁরা একটু হলেও আশান্বিত হন যে, তাঁর বইটি এতো কপি চলবে। কিন্তু দিন শেষে যখন হিসাব মেলাতে পারেন না, তখন কি একটু হলেও বুক ভার হয় না?
আমরা ব্লগাররা এই বিষয়গুলোতে একটু দায়িত্বশীল হতে পারি নিশ্চয়ই!