কিছুদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার অধিবাসীরা গ্যাসের দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছে। এই থানার অন্তর্গত সালদা নদীতে যে গ্যাস পাওয়া গেছে, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই গ্যাস কসবা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সরবরাহ করার। পত্রিকার খবর অনুসারে, সালদা গ্যাস ফিল্ডের তিন নম্বর কূপ থেকে ২২ নভেম্বর থেকে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেডের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে অন্তত ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে যা মূলত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার বাসিন্দারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল-সমাবেশ-মানবন্ধনসহ নানা ধরনের প্রতিবাদ করেছে। অবশ্য পাইপলাইনে কোনোমতেই গ্যাস না দেওয়ার হুমকিধামকিও দেয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। কসবাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের চাহিদা মিটিয়ে তবেই কেবল বাকি গ্যাস দেশের অন্যত্র সরবরাহ করা যাবে, অন্যথায় তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আরো বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবে। এই গ্যাসের দাবিতে কসবায় যেদিন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়, সেদিন মানববন্ধন চলাকালে পুরো কসবা প্রায় থমকে গিয়েছিল। অফিস-দোকানপাট সবকিছুই বন্ধ ছিল। পত্রিকায় এভাবেও খবর এসেছে যে- কসবাবাসী অঘোষিতভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হরতাল পালন করেছে। এই চিত্র থেকেই বুঝা যায়, গ্যাসের দাবিতে কসবাবাসী কতোটা একাট্টা! কসবাবাসীর এতো জোড়ালো আন্দোলনের পেছনে আরো কারণ ছিল। সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা এর আগে নানা সময় কসবাবাসীকে গ্যাস সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধিদের কথায় কসবাবাসী সে সময় আশ্বস্ত হলেও যখন দেখা গেল সরকার অন্যত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, তখন তারা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছে।
একটি দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে তেল-গ্যাস-কয়লা বা এ ধরনের জাতীয় সম্পদ পাওয়া গেলে দেশের সার্বিক উন্নতির স্বার্থে এই সম্পদ কোথায় ব্যবহার করা হবে, তা মূলত সরকারই ঠিক করে থাকে। সরকার নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেশের শিল্পকারখানার বিকাশ ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জ্বালানি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়। ফলে যে এলাকায় এ সম্পদ পাওয়া যায়, শুধু সেই এলাকাতেই প্রাপ্ত সম্পদের ব্যবহার করতেই হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা সরকারের নেই। সরকারকে শুধু একটি এলাকা নিয়ে চিন্তা করলে চলে না। দেশ পরিচালনার স্বার্থে সরকারকে এমন অনেক অপ্রিয় ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হয় যেগুলো হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় জনগণের মনে বেদনা উদ্রেক করে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় স্থানীয় সম্পদের স্থানীয় ব্যবহার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান নাও রাখতে পারে।
সালদা নদীর প্রাপ্ত গ্যাস কেন চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সরকারের কাছে রয়েছে। কসবার অধিবাসীরা গ্যাসের দাবিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে কী জবাব দিয়েছে জানা নেই। সরকার আদৌ কোনো জবাব দিয়েছে কিনা সেরকম খবর মিডিয়াতে পাওয়া যায় নি। তবে যে জবাবই সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হোক না কেন, কসবাবাসী যে সন্তুষ্ট নয় তা তাদের পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচিতেই বুঝা গেছে। এই ঘটনা মূলত দুটো বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়, যার যে কোনো একটি অথবা দুটোই সত্যি হতে পারে। এক. সরকার কসবাবাসীকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে কেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কসবাবাসীকে বঞ্চিত করে প্রাপ্ত গ্যাস চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে হবে। বুঝাতে সফল হলে কসবাবাসীর আন্দোলন থেমে যেত। দুই. কসবাবাসীও সম্ভবত স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই আছে যে সরকার যা-ই বলুক না কেন বা সরকারের সিদ্ধান্ত যতো যৌক্তিকই হোক না কেন, তারা গ্যাসের দাবিতে কোনো ছাড় দিবে না। এক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছে তা একজন বাইরের এলাকার মানুষের পক্ষে বুঝাটা দুরূহ। সরকার যদি তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষের যুক্তিগুলো সবার কাছে খোলামেলাভাবে প্রকাশ করতো তাহলে শুধু কসবাবাসীও নয়; সারা দেশের মানুষও বুঝতে পারতো কসবাবাসীর এই আন্দোলন যৌক্তিক কিনা!
আগেই বলা হয়েছে, যেখানে জ্বালানি সম্পদ পাওয়া যাবে শুধু সেখানকার চাহিদা মেটাতে হবে এমন কোনো স্থির সিদ্ধান্ত একটি দেশের সরকার কখনোই নিতে পারে না। জ্বালানি সম্পদের যে বহুমুখী চাহিদা রয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে তার যথাযথ ব্যবহার নাও ঘটতে পারে। তাছাড়া জ্বালানি সম্পদের সঠিক ব্যবহারের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, সেই অবকাঠামো স্থানীয় পর্যায়ে না থাকলে এই সম্পদ সেখানে কীভাবে ব্যবহার করা হবে? এখন যে ধরনের জ্বালানী সম্পদ স্থানীয় পর্যায়ে আবিষ্কৃত হয়েছে, অবকাঠামো তৈরিতেই যদি এর অর্ধেকও খরচ হয়ে যায়, তাহলেও তা অর্থনৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য নয়। যতদূর জানা যায়, কসবাতে মূলত বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করার দাবি উঠেছে। শিল্পকারখানা সেখানে এমন পর্যায়ে নেই যে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাসের প্রয়োজন হবে সেখানে। এই পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই মনে হয়।
তবে অন্যান্য জ্বালানি সম্পদ যেমন তেল ও কয়লার তুলনায় গ্যাস সম্পদের ভিন্ন ব্যবহার রয়েছে। তেল ও কয়লা মূলত স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহার করা যায় না কারণ সেগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিশেষভাবে ব্যবহার করতে হয়। বিশেষায়িত কারখানা বা এরকম কিছু না থাকলে তেল বা কয়লা মূলত নির্দিষ্ট কিছু গণ্ডীর বাইরে ব্যবহৃত হয় না। তেল সম্পদ পরিশোধনের দরকার পড়ে। খনিজ কয়লা সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু গ্যাসের ক্ষেত্রে এমন সীমাবদ্ধতা কম। গ্যাস পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পাইপলাইন তৈরি করে সহজেই বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় সংযোগ দেয়া যায়। সুতরাং তেল কিংবা কয়লার মতো গ্যাসকে একই কাতারে ফেলা যায় না এবং এক্ষেত্রে স্থানীয় চাহিদাকেও গুরুত্ব দেয়া যায়।
কসবা থেকে যে পরিমাণ গ্যাস সরকার চট্টগ্রামে নিয়ে যাবে, তার কতোটুকু শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা হবে? বাসাবাড়িতে কতোটুকু ব্যবহার করা হবে? সেরকম কোনো হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে উন্মুক্তভাবে জানানো হয় নি। তবে ধরে নেয়া যায়, এই গ্যাসের বড় অংশটি খরচ হবে শিল্পকারখানার পিছনে; বাকিটুকু বাসাবাড়িতে। শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি না হয় দেশের উন্নতির স্বার্থে মেনে নেওয়া গেল; কিন্তু কসবাবাসী যদি জানতে চায় তাদের এলাকায় পাওয়া গ্যাস কেন তাদের বাসাবাড়িতে ব্যবহার না করতে গিয়ে চট্টগ্রামের বাসাবাড়িতে ব্যবহার করতে দিবে- সরকার তখন কী উত্তর দিবে? স্থানীয় সম্পদের উপর স্থানীয় জনগণ কি এইটুকু অধিকার দাবি করতে পারে না? আমরা আমাদের সমস্ত নাগরিক সুবিধা কিছু নির্দিষ্ট শহরের জন্য বরাদ্দ করেছি, গ্রাম বা মফস্বল শহরগুলো সেদিক দিয়ে যথেষ্ট অবহেলিত। সমস্ত গ্রামীণ বা স্থানীয় সম্পদকে চুষে শহরাঞ্চলকে স্ফীত করার যে নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস, নতুন গ্যাসও সেই ধারাবাহিকতায়ই কসবা থেকে চট্টগ্রামে যাবে। যে এলাকায় খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়, সেই এলাকাকে ঘিরে যদি শিল্পের ও নাগরিক সুবিধা বিকাশ ঘটানো যায়, তাহলে তো দেশের অনেক এলাকাতেই আস্তে আস্তে উন্নতির ছোঁয়া পড়ে! সরকার কি এই বিষয়গুলো ভাবে? ভোটের রাজনীতিতে কসবার চেয়ে চট্টগ্রাম তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ- এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে কি এটাও কারণ?
ইতোমধ্যে এটাও জানা গেছে, চট্টগ্রামে যে পরিমাণ গ্যাসের ঘাটতি আছে (সম্ভবত ২২ মিলিয়ন ঘনফুট), তার উল্লেখযোগ্য অংশ (প্রায় ১৮ মিলিয়ন ঘনফুট) আগামী জানুয়ারি থেকে সেমুতাং গ্যাস ফিল্ড থেকে সরবরাহ করা হবে। সেদিক দিয়ে সালদা গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস চট্টগ্রামের জন্য খুব একটা জরুরি না। সুতরাং সরকার চাইলেই কসবাবাসীর দাবি মেটানোর উদ্যোগ নিতে পারে।
স্থানীয় সম্পদের উপর স্থানীয় জনগণের অধিকার থাকা উচিত; কারণ তারাই এ সম্পদের রক্ষা করে। এক জায়গার সম্পদ অন্য জায়গায় নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার যতোই দেশের উন্নতির দোহাই দিক বা অন্য কোনো কারণ বলুক না কেন, এটাও মনে রাখা দরকার এই স্থানীয় মানুষগুলোর উন্নতিও দেশের উন্নতি। এদের বাদ দিয়ে শহরভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা কেবল বৈষম্যই সৃষ্টি করে। এ সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে কসবাবাসী তাদের নিজ এলাকায় গ্যাস সংযোগের যে দাবি তুলেছে, সেটিকে খুবই যৌক্তিক মনে হয়। এই গ্যাসের ওপর কসবাবাসীর অধিকারকে সম্মান জানানোর জন্যও এটা করা দরকার।